মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আটকে পড়ছে, যারা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারছে না, কোনরকম নিরাপত্তা বা সহায়তা ছাড়াই তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
“আমরা বিস্ফোরণ, গুলির শব্দ এবং মানুষের চিৎকার শুনেছি,” ১৭ মে সন্ধ্যায় যখন বুথিডাং অঞ্চলে আক্রমণ করা হয়েছিল সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছেন রুহুল। “আমার পরিবার এবং আমি এ বিশৃংখল অবস্থার মধ্যে নিরাপত্তার খোঁজে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে নিকটবর্তী পাহাড়ে যাই। “
“আমি আমার বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে যাই এবং আমার চাচাতো ভাই-বোন এবং অন্যান্য যুবকদের সাথে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে ক্ষুধা ও ভয় নিয়ে বেশ কিছু দিন কাটিয়েছি। এ সময় দুটি ল্যান্ডমাইনে আমার পা পড়ে; প্রথমবার অক্ষত থাকলেও দ্বিতীয়ি বিস্ফোরণে আমার পা উড়ে যায়।” রুহুল, একজন তরুণ রোহিঙ্গা, যিনি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং কক্সবাজারের মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ারস/সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল (এমএসএফ) হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত নয় দিন ধরে কোন চিকিৎসা সেবা পাননি।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং আরাকান সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘাতের কারণে মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যটি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। ভারী অস্ত্রের ব্যবহার, ড্রোন হামলা এবং অগ্নিসংযোগসহ চরম সহিংসতা সমগ্র গ্রামগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে, বেসামরিক মানুষকে হত্যা, আহত ও বাস্তুচ্যুত করেছে।এ সংঘর্ষে উভয় পক্ষই জোরপূর্বক বেসামরিক নাগরিকদের নিয়োগ করছে এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত উত্তেজনা সৃষ্টি করছে।
এই সহিংসতা রাখাইনে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীকেে প্রভাবিত করছে, তবে কয়েক দশক ধরে ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে নির্যাতিত গোষ্ঠীগুলির মধ্যে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় প্রায়শই এই সহিংসতার মাঝে পড়ে যান।
১৭ এবং ১৮ মে বুথিডাং-এ, বেসামরিক বাড়িঘর এবং সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গা (যাদের মধ্যে অনেকে পূর্বে অন্য এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল) নিজ শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
একই দিনে বুথিডাং থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া আরেক রোহিঙ্গা হলেন মুজিবুল্লাহ। “একটি মর্টার শেল আমাদের বাড়িতে আঘাত করে, আমার স্ত্রীকে হত্যা করে এবং আরও কয়েকজন আহত হয়” তিনি বলেছেন। “আমরা বাংলাদেশে যাওয়ার হৃদয়বিদারক সিদ্ধান্ত নেই। বাড়িঘর, গবাদিপশু এবং ফসল ছেড়ে চলে আসাটা আমাদের জন্য অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন ছিল।”
বুথিডাং থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমের মংডুতে, মে মাসে যুদ্ধরত দলগুলির মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয় এবং আগস্টে তা আবার বেড়ে যায়। তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের উপর সহিংস আক্রমণ চালায় – যাদের মধ্যে কেউ কেউ বুথিডাং-এর হামলা থেকে বেঁচে গেছে।
৫ই আগস্ট থেকে ১৭ই আগস্টের মধ্যে, বাংলাদেশের কক্সবাজার ক্যাম্পে এমএসএফ দল যোদ্ধাহত ৮৩ জন রোহিঙ্গা রোগীর চিকিৎসা সেবা দিয়েছে; যার মধ্যে ৪৮ শতাংশই নারী ও শিশু। তারা মংডুতে আক্রমণ থেকে পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেছে বলে জানিয়েছে।
এমএসএফ-এর হাসপাতালগুলিতে আগত এই রোগীরা বন্দুকের গুলির আঘাতে ভুগছেন, ল্যান্ডমাইনের আঘাতে পঙ্গু হয়েছেন এবং এইচআইভি বা যক্ষ্মা রোগের মতো প্রাণঘাতী অসুস্থতার পর্যাপ্ত ঔষধের অভাবে গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন। এই ঔষুধগুলি আর রাখাইনে পাওয়া যায় না।
নাফ নদী পার হয়ে সীমান্তের এপারে আসাটাকে অনেক মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন। সীমান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ থাকায়, মানুষ সীমান্ত পার হওয়ার জন্যে কর্তৃপক্ষ, সশস্ত্র গোষ্ঠী বা চোরাকারবারিদের বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছে।
“বাংলাদেশে আসার যাত্রার প্রত্যেকটি মোড় অনেক কঠিন ছিল,” মুজিবুল্লাহ বলেছেন। “আমরা চোরাকারবারীদের মুখোমুখি হয়েছি যারা বিপজ্জনক নৌকা ভ্রমণের জন্য অতিরিক্ত ফি দাবি করছে এবং বাংলাদেশে আসার পর বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছ থেকে বিরূপঅভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। আমার নাতি-নাতনির জরুরি চিকিৎসা সেবার সাহায্যের জন্য আবেদন করা সত্ত্বেও, আমাদেরকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।”
উত্তর রাখাইনে, স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা প্রায় নেই বললেই চলে। যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলি অকার্যকর হয়ে পড়েছে, সহিংসতা থেকে বাঁচার জন্য চিকিৎসাকর্মীরা পালিয়ে গেছে, অথবা যুদ্ধের গতিশীলতার কারণে সরবরাহ বন্ধ থাকা, প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহের অনুমতি না পাওয়া ইত্যাদি কারণে স্বাস্থ্যসেবা অকার্যকর হয়ে পড়েছে ।
জুন মাসে, আমাদের কার্যালয় এবং মেডিক্যাল স্টোর পুড়িয়ে ফেলার পর, এমএসএফ বুথিডাং , মংডু এবং রাথেডং শহরে আমাদের মানবিক চিকিৎসা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে। কার্যক্রম স্থগিত করার আগে, এমএসএফ ঐ এলাকার বাজার ও গ্রামের মতো জনবহুল বেসামরিক এলাকা হামলার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলিতে হামলা প্রত্যক্ষষ্য করেছিল যা রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জীবনকে হুুমকির মুখে ফেলেছিল।
আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে বেসামরিক নাগরিকদের সরক্ষা এবং তাযুদ্ধরত দলগুলির মধ্যে কিছু বাধ্যবাধকতা বজায় রাখার জন্যে যদি কোন প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েও থাকে, তা ছিল অতি নগণ্য।
মানুষের জীবনের প্রতি এই অবজ্ঞার প্রভাব অপরিসীম। বাংলাদেশে এমএসএফ টিম ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ১১৫ জন যুদ্ধে আহত রোহিঙ্গা রোগী পেয়েছে, যার মধ্যে চরম সহিংসতায় আহত পুরুষু, মহিলা এবং শিশু রয়েছে। কক্সবাজারে সদ্য–আগত রোহিঙ্গারা যখন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসতে এবং কিছু স্তরের চিকিৎসা সেবা পেয়েছে, তারা মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ভয়ে ক্রমাগত লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে এবং সেই সাথে ক্যাম্পে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে যেখানে ১.২ মিলিয়ন মানুষ কাঁটাতারের বেড়ার ভিতরে বসবাস করছে। মিয়ানমারে সশস্ত্র গোষ্ঠীতে জোরপূর্বক নিয়োগ সহ ক্যাম্পে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং অপহরণ ছাড়াও, অনেক মানুষ বাংলাদেশে তাদের পরিবারের ভাগ্য এবং তাদের বাড়িতে/দেশে ফিরে যাওয়া নিয়ে ভয় ও উদ্বেগের মধ্যে বসবাস করছে।
অবশেষে, বাংলাদেশে পৌঁছেও মুজিবুল্লাহ এখনো কষ্ট থেকে মুক্তি পাননি। “আমার পরিবার ও আমি প্রিয়জন হারানো এবং আমাদের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকে মানিয়ে নিতে সংগ্রাম করছি।”
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারে সংঘাত পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকে রাখাইন রাজ্য এবং চিন রাজ্যের পালেতোয়া টাউনশিপ থেকে আনুমানিক ৩২৭,০০০জন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এছাড়াও, রাখাইন রাজ্য এবং পালেতোয়া শহর থেকে মোট বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৫৩৪,০০০ জনের বেশি। এমএসএফ এই সংঘর্ষের পক্ষগুলিকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এবং বৈষম্য, আনুপাতিকতা এবং সতর্কতার নীতি অনুসরণ করার আহ্বান জানাচ্ছে৷ এর মধ্যে রয়েছে সরাসরি আক্রমণ এবং আক্রমণের প্রভাব থেকে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করা, সেইসাথে নির্বিচারে আক্রমণ বন্ধ করা। আমরা সীমান্তের উভয় পক্ষের কর্তৃপক্ষ এবং সমস্ত সংস্থাগুলোকে অবিলম্বে নিরপেক্ষ মানবিক এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সহায়তা প্রদান ও বর্ধিত করার অগ্রাধিকার দিতে আহ্বান করছি।
*গোপনীয়তা রক্ষার্থে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।